প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনঃ বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম
- খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই মানুষ জটিল জীবনধারা থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বচ্ছ, সুন্দর , অনাবিল জীবনধারার দিকে ঝুঁকেছিল।
- চীনে কনফুসিয়াস, পারস্যে জরাথ্রুষ্ট, ব্যাবিলনে হেরাক্লিটাস এবং ভারতে গোতম বুদ্ধ ও মহাবীর জনগণকে শান্তি ও মুক্তির পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
- বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আচার অনুষ্ঠান, ব্যয়বহর যাগযজ্ঞ, পশুবলি, ব্রাহ্মণ্য পুরোহিতদের একাধিপত্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে জটিল হিন্দু ধর্মের প্রতিবাদ স্বরূপ যে ধর্মীয় আন্দোলনের সূচনা হয় তা প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন নামে পরিচিত।
- বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থানুসারে ভারতবর্ষে ৬৩টি প্রতিবাদী ধর্মের উত্থান ঘটেছিল যার মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম অন্যতম।
গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম
জন্ম :৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ( মতান্তরে ৫৬৬) বৈশাখী পূর্ণিমার দিন নেপালের কপিলাবস্তু নিকট লুম্বিনী উদ্যানে ক্ষত্রিয় শাক্য পরিবারে
পরিবার পরিচয় :
- পিতা – শুদ্ধোধন (শাক্য রাজবংশ)
- মাতা – মায়া দেবী (কোশালা রাজবংশ)
- মাসী – প্রজাপতি গৌতমী (বুদ্ধকে লালন পালন করেন)
- স্ত্রী – গোপা ( মতান্তরে যশোধরা)
- পুত্র – রাহুল
অপর নাম : গৌতম, সিদ্ধার্থ, শাক্যমুনি, তথাগত
দাম্পত্য :১৬ বছর বয়সে গোপা (মতান্তরে যশোধরা) নামে জনৈক এক শাক্যকুমারীর সাথে বিবাহ হয়। এরপর ১৩ বছর সংসার ধর্ম পালন করেন। তাঁদের একমাত্র পুত্র সন্তানের নাম রাহুল।
গৃহত্যাগ : একজন বৃদ্ধ (an old man), একজন রোগী (a diseased person), একজন তপস্বী (an ascetic) এবং একটি মৃতদেহ (a dead body) দেখে তিনি ব্যথিত হন। পুত্রের জন্মের পর সংসার ধর্মে আর জড়িয়ে পড়ার ভয়ে ২৯ বছর বয়সে এক গভীর রাতে তিনি সংসার ত্যাগ করেন। এই ঘটনাকে ‘মহাভিনিষ্ক্রমণ’ বলা হয়।
বুদ্ধত্ব লাভ :
- প্রথমে তিনি আলারা কালমা নামক এক ঋষির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
- তাঁর পরবর্তী শিক্ষক ছিলেন উদ্রক রামপুত্র।
- পরে তিনি তপস্বীদের সঙ্গ ত্যাগ করে গয়ার কাছে উরুবিল্ব নামক স্থানে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে গভীর ধ্যানে মগ্ন হন।
- এখানেই তিনি বোধি/নির্বাণ লাভ করেন।
- সুজাতা নামে এক চাষির(মতান্তরে বণিককন্যা ) মেয়ে তাঁকে পায়েস খাওয়ান।
- যে বৃক্ষের নীচে তিনি বোধি লাভ করেন সেতি বোধিবৃক্ষ এবং এই জায়গাটি পরে বুদ্ধগয়া নামে পরিচিত হয়।
- বোধি লাভের পর তিনি বুদ্ধ বা তথাগত নামে পরিচিত হন।
ধর্মপ্রচার :
- প্রথম ধর্মপ্রচার করেন সারনাথের মৃগদাব অরণ্যে পাঁচশিষ্য (বাস্প, ভদ্রিয়, অশ্বজিৎ, মহানামা ও কৌন্দিন্য) এর কাছে। এঁদের একত্রে বলা হয় পঞ্চভিক্ষু। এই ঘটনা ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন’ নামে পরিচিত।
- তাঁর দীক্ষিত প্রথম সন্ন্যাসিনী হলেন তাঁর বিমাতা গৌতমী।
- তিনি মগধী প্রাকৃত ভাষায় ধর্ম প্রচার করেন।
দেহত্যাগ :৮০ বছর বয়সে মল্ল মহাজনপদের রাজধানী কুশিনগরে (বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর) ৪৮৩(মতান্তরে ৪৮৬) খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেহত্যাগ করেন। এই ঘটনা ‘মহাপরিনির্বান’ নামে পরিচিত।
আর্যসত্যঃ
- দুঃখ- জীবন দুঃখময়
- সমুদায়- দুঃখের কারন আছে তা হল তৃষ্ণা
- নিরোধ- দুঃখ নিবারণ সম্ভব
- অষ্টাঙ্গিক মার্গ- অষ্টাঙ্গিক মার্গের দ্বারা দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব
অষ্টাঙ্গিক মার্গঃ
- সৎ সংকল্প(Right Determination)
- সৎ চিন্তা(Right Memory)
- সৎ বাক্য(Right Speech)
- সৎ ব্যবহার(Right Action)
- সৎ জীবনযাপন(Right Livelihood)
- সৎ চেষ্টা(Right Exercise)
- সৎ দৃষ্টি(Right Observation)
- সৎ সমাধি(Right Meditation)
পঞ্চশীলঃ১) লোভ ২) হিংসা ৩) অসত্য ৪) দুর্নীতি ৫) অন্যায় – এগুলি না করা
বৌদ্ধধর্মে ত্রিরত্নঃ বুদ্ধ (The Enlightened), ধর্ম (Doctrine), সংঘ ( Monastic Order)
গৌতম বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও তার প্রতীক
- জন্ম (Birth)– পদ্মফুল ও ষাঁড়(Lotus and Bull)
- গৃহত্যাগ বা মহাভিনিষ্ক্রমণ (Renunciation)– ঘোড়া(Horse)
- বোধিলাভ/নির্বাণ (Enlightenment)-বোধি বৃক্ষ(Bodhi Tree)
- ধর্মচক্র প্রবর্তন (First Sermon)- চাকা(Wheel)
- দেহত্যাগ বা মহাপরিনির্বাণ (Death)– স্তূপ(Stupa)
বৌদ্ধ সংগীতি / বৌদ্ধ সম্মেলন
প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলন
- ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বিহারের রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহাতে হয়েছিল।
- এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মগধের রাজা অজাতশত্রুর আমলে।
- সভাপতি ছিলেন মহাকাশ্যপ।
- আনন্দ সুত্ত পিটক ও উপালি বিনয় পিটক রচনা করেন।
দ্বিতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন
- ৩৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বিহারের বৈশালী তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
- এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মগধের রাজা কালাশোকের আমলে ।
- সভাপতি ছিলেন সাবাকামি।
- বৌদ্ধ ধর্মের অনুগামীরা স্থবিরবাদি ও মহাসংঘিকাশ নামে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন
- ২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাট অশোকের তত্ত্বাবধানে বিহারের পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত হয়।
- সভাপতি ছিলেন মোগালীপুত্ত তিস্যা।
- এই সময় অভিধম্ম পিটক রচিত হয়।
- ভারতের বাইরে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি
- ৭২ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মীরের কুন্দলবনে রাজা কনিস্কের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়।
- সভাপতি ছিলেন বসুমিত্র, সহকারি সভাপতি ছিলেন অশ্বঘোষ।
- বৌদ্ধ ধর্ম হীনযান (যারা মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করত না এবং পালি ভাষাকে প্রাধান্য দিত) ও মহাযান(মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করত এবং সংস্কৃত ভাষাকে বেশি প্রাধান্য দিত) এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
- বসুমিত্র ত্রিপিটকের ব্যাখ্যাসমূহ "মহাবিভাষা" নামক সংস্কৃত গ্রন্থে সংকলিত করেন।
বৌদ্ধ সাহিত্য
বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক পালি ভাষায় রচিত হলেও সংস্কৃত ভাষাতেও অসংখ্য বৌদ্ধগ্রন্থ পাওয়া যায়।
পালি ভাষায় রচিত গ্রন্থ
- ত্রিপিটক –পিটক কথার অর্থ হল ঝুড়ি( BASKET)। বুদ্ধের বাণীগুলি পাতার উপর লিখে ঝুড়িতে রাখা হত তাই এই নাম। এই রকম তিনটি পিটক নিয়ে ত্রিপিটক।
- সুত্ত পিটক- এটি আনন্দ রচনা করেন। বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশ এই গ্রন্থে পাওয়া যায়।
- বিনয় পিটক- উপালি রচনা করেন বিনয় পিটক। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের নিয়মাবলী রয়েছে এই পিটকে।
- অভিধম্ম পিটক- বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে অভিধম্ম পিটকে।
- মিলিন্দাপানহো – বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের লেখা। এটি ইন্দো গ্রিক রাজা মিনান্দার এবং নাগসেনের কথোপকথন।
- দীপবংশ ও মহাবংশ – সিংহলী(শ্রীলঙ্কা) বৌদ্ধগ্রন্থ।
- জাতকের গল্প – বুদ্ধের পূর্বজন্ম সম্বন্ধে লেখা আছে।
সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ
- অশ্বঘোষের লেখা ‘বুদ্ধচরিত’
- বসুমিত্রের লেখা ‘মহাবিভাষা’
- ললিতবিস্তর - গৌতম বুদ্ধের জন্ম থেকে মহাপরিনির্বান পর্যন্ত বিষয়াদিই ললিতবিস্তর গ্রন্থে পাওয়া যায়। মূল গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও পরবর্তী কালে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারঃ
- হর্যঙ্ক বংশের রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রু বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।
- কোশালার রাজা প্রসেনজিৎ, ইন্দো গ্রিক রাজা মিনান্দার, পুষ্যাভুতি বংশের রাজা হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।
- কলিঙ্গ যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে মৌর্য সম্রাট অশোক যুদ্ধ নীতি রদ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। উপগুপ্ত নামে একজন বৌদ্ধ ধর্মগুরুর কাছে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
- অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা শ্রীলঙ্কাতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।
- সম্রাট অশোকের আমলে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বধর্মে পরিণত হয়।
- কূষাণ রাজা কনিস্ক অশ্বঘোষের কাছে বৌ দিক্ষিত হন।
- যেসকল পাল রাজা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন– গোপাল, ধর্মপাল, রামপাল
বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থে উল্লিখিত "জীবক" ছিলেন বুদ্ধের সমসাময়িক চিকিৎসক।
- গৌতম বুদ্ধ ভোগবিলাসে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মধ্যমপন্থা বা "মঝঝিম পন্থা" অবলম্বনের পক্ষপাতি ছিলেন।
- অতীশ দীপঙ্করকে দ্বিতীয় বুদ্ধ বলা হয়।
- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গৌতম বুদ্ধকে "শ্রেষ্ঠ মানব" বলেছিলেন।
মহাবীর ও জৈন ধর্ম
জৈন শব্দের উৎপত্তি :'জিন' শব্দ থেকে জৈন শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। 'জিন' শব্দের অর্থ জয়ী। যে ব্যক্তি আসক্তি, অহংকার, লোভ প্রভৃতি অন্তঃপ্রবৃত্তিগুলি জয় করেছেন তাঁকে জিন (জিতেন্দ্রিয়) আখ্যা দেওয়া হয়।
তীর্থঙ্কর :জৈন ধর্মের প্রবর্তকদের বলা হয় তীর্থঙ্কর। তীর্থঙ্কর ক্তহার অর্থ মুক্তির পথদাতা। জৈন ধর্মের ইতিহাসে মোট ২৪ জন তীর্থঙ্কর রয়েছেন। এরা হলেন-
ক্রম | তীর্থঙ্কর | প্রতীক |
১ | ঋষভদেব বা আদিনাথ | ষাঁড় |
২ | অজিতনাথ | হাতি |
৩ | সম্ভবনাথ | ঘোড়া |
৪ | অভিনন্দন নাথ | বানর |
৫ | সুমতিনাথ | রাজহাঁস |
৬ | পদ্মপ্রভ | পদ্ম |
৭ | সুপার্শ্বনাথ | স্বস্তিকা |
৮ | চন্দ্রপ্রভ | চাঁদ |
৯ | সুবিধিনাথ স্বামী বা পুষ্পদন্ত | কুমির |
১০ | শীতলনাথ | কল্পবৃক্ষ |
১১ | শ্রেয়াংসনাথ | একশৃঙ্গ গন্ডার |
১২ | বাসুপুজ্য | মহিষ |
১৩ | বিমলনাথ | বন্য শূকর |
১৪ | অনন্তনাথ | ভাল্লুক /বাজপাখি |
১৫ | ধর্মনাথ | বজ্রদন্ড |
১৬ | শান্তিনাথ | হরিন |
১৭ | কুন্থুনাথ | ছাগল |
১৮ | অরনাথ | মাছ |
১৯ | মল্লিনাথ | কলস |
২০ | মুনিসুব্রত | কচ্ছপ |
২১ | নমিনাথ | নীলপদ্ম |
২২ | নেমিনাথ/অরিষ্টনেমি | শঙ্খ |
২৩ | পার্শ্বনাথ | সাপ |
২৪ | মহাবীর | সিংহ |
- সর্বপ্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ঋষভদেব বা আদিনাথ।
- জৈন ধর্মের প্রকৃত প্রবর্তক ছিলেন ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ।
- জৈন ধর্মের প্রধান প্রবর্তক ছিলেন ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর।
- একমাত্র মহিলা তীর্থঙ্কর ছিলেন ১৯তম তীর্থঙ্কর মল্লিনাথ ।
- ঋকবেদে দুই জন জৈন তীর্থঙ্করের নাম পাওয়া যায়- প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভদেব এবং ২২তম তীর্থঙ্কর অরিষ্টনেমি।
- উত্তরপ্রদেশে প্রাপ্ত "কোহম" শিলালিপি থেকে শেষ ৪ জন তীর্থঙ্কর সম্বন্ধে জানা যায়।
পার্শ্বনাথ ( ২৩তম তীর্থঙ্কর )
- খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে কাশির এক রাজবংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
- ৩০ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন।
- ঝাড়খণ্ডের পরেশনাথ পাহাড়ে দেহত্যাগ করেন।
- তিনি চতুর্যাম প্রথার প্রবর্তন করেন।
- অহিংসা
- সত্যবাদিতা বা চুরি না করা
- অচৌর্য
- অপরিগ্রহ অর্থাৎ পরদ্রব্য গ্রহণ না করা বা কোন বস্তুর প্রতি লোভ না করা
মহাবীর:
- বিহারের বৈশালীর কুন্দগ্রামে(বর্তমান বিহারের মুজফফরপুর জেলার বসার গ্রাম) ৫৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ( মতান্তরে ৪৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ) ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্য নাম ছিল বর্ধমান
- বংশ পরিচয় :
- পিতা – সিদ্ধার্থ (জ্ঞাত্রিক গোষ্ঠীর প্রধান )
- মাতা – ত্রিশলা (লিচ্ছবি বংশীয় রাজকন্যা )
- পত্নী – যশোদা
- কন্যা – প্রিয়দর্শনা
- জামাতা – জামালি ( মহাবীরের প্রথম শিষ্য )
- প্রথম শিক্ষাগুরু – মাখালি গোসালা
- গৃহত্যাগ :
- ৩০ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর তিনি সত্যের সন্ধানে মাখালি গোসালার সাথে গৃহত্যাগ করেন।
- পরবর্তীকালে মতপার্থ্যকের জন্য গোসালা মহাবিরকে ত্যাগ করে আজিবক সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন।
- ১২ বছর সাধনার পর ৪২ বছর বয়সে, ঋজুপালিকা নদীর তীরে জম্ভিকগ্রামে একটি শাল গাছের নিচে তিনি কৈবল্য ( Supreme Knowledge ) লাভ করে জিন বা জিতেন্দ্রিয় নামে পরিচিত হন।
- চিরতরে বস্ত্র ত্যাগ করে নিগন্থ(সংসার বন্ধনহীন) হন।
- ধর্মপ্রচার :
- মহাবীর পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত চতুর্যাম-এর সাথে ব্রহ্মচর্য যুক্ত করেন যা পঞ্চমহাব্রত নামে পরিচিত।
- মহাবীর তার প্রথম ধর্মপ্রচার করেন পাবাতে তার ১১ জন শিষ্যকে যারা ১১ গান্ধারা নামে পরিচিত। পরে তিনি পাবাতে একটি জৈন শ্রমণ সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। এই ১১জন শিষ্যের মধ্যে একমাত্র সুধর্ম বেঁচে ছিলেন মহাবীরের মৃত্যুর পর।
- এর পর তিনি প্রায় ৩০ বছর সারা ভারত পরিভ্রমণ করেন এবং নিজের দর্শন শিক্ষা দেন।
- তার অনুগামী রাজন্যবর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মগধের রাজা বিম্বিসার, অজাতশত্রু, কলিঙ্গরাজ খারবেল, অঙ্গের রাজা কুণিক,বিদেহের রাজা চেতক।
- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শেষ জীবনে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন।
- মৌর্য সম্রাট অশোকের নাতি সম্পারিত জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন।
- মোক্ষ (নির্বাণ):
- ৪৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৭২ বছর বয়সে মহাবীর মোক্ষ (জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি) লাভ করেন এবং তার আত্মা এখন ‘সিদ্ধশিলা’য় (মুক্ত আত্মাদের স্থান) অবস্থান করছে।
- জৈন ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, মহাবীর পাবাপুরীতে দেহত্যাগ করেন।
- প্রবচনসার অনুসারে, মৃত্যুর পরে মহাবীরের শুধু নখ আর চুলই শুধু পড়ে থাকে। অবশিষ্ট শরীর কর্পূরের মতো হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়।
- মহাবীর যেখানে মোক্ষ লাভ করেছিলেন বলে মনে করা হয়, সেখানে বর্তমানে জল মন্দির নামে একটি জৈন মন্দির রয়েছে।
জৈনধর্মের ত্রিরত্ন
- সম্যক শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস ( Right Faith )
- সম্যক জ্ঞান ( Right Knowledge )
- সম্যক কর্ম ( Right Action/Conduct )
জৈন ধর্মের মূল কথা
- বেদ ও বেদের রীতির বিরোধিতা
- ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করা
- কর্ম ও আত্মার শুদ্ধিতে বিশ্বাস
- সকলের সমান অধিকার
জৈনধর্মের ভাগ
- শ্বেতাম্বর :পার্শ্বনাথের ন্যায় স্বেতবস্ত্র পরিধান করতো। স্থুলভদ্র শ্বেতাম্বর ছিলেন।
- দিগম্বর :মহাবীরের ন্যায় নগ্নতাকে গ্রহণ করেছিল। ভদ্রবাহু দিগম্বর ছিলেন।
জৈন ধর্মসম্মেলন
- প্রথম ধর্মসম্মেলন
- ৩২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থুলভদ্রের সভাপতিত্বেপাটলীপুত্রতে হয়েছিল।
- শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর -এই দুই সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়
- দ্বিতীয় ধর্মসম্মেলন
- ৫১৩ খ্রীস্টাব্দতে বল্লভীতে হয়েছিল
- সভাপতি ছিলেন দেবার্ধি
- জৈনদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ দ্বাদশ অঙ্গের সংকলন হয়
জৈন সাহিত্য
- জৈন সাহিত্যগুলি প্রধানত প্রাকৃত বা অর্ধমাগধী প্রাকৃত ভাষায় রচিত ছিল।
- ভদ্রবাহু রচিত কল্পসূত্র হল জৈনদের আদি শাস্ত্রগ্রন্থ। ১৪টি পর্বে রচিত এই গ্রন্থ থেকে মহাবীরের বাণী সম্পর্কে জানা যায়।
- সাহিত্যগুলি নিম্নলিখিত ভাগে বিভক্ত ছিল
- দ্বাদশ অঙ্গ
- ১২ উপাঙ্গ
- ১০ পরিকরনাস
- ৬ ছেদাসূত্র
- ৪ মূলসূত্র
- ২ সূত্রগ্রন্থ
জৈন স্থাপত্য
- ওড়িশা – হাতিগুম্ফা, বাঘগুম্ফা, উদয়গিরি, খন্ডগিরি।
- গুজরাট – গিরনার ও পালিতানা মন্দির।
- বিহার – পাবাপুরী ও রাজগৃহ
- কর্ণাটক – গোমতেশ্বর, বাহুবলি, শ্রবণগোলা
- রাজস্থান – মাউন্ট আবুর দিলওয়ারা মন্দির, বিমলাভাসাহী ও তেজপুর মন্দির।